Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ (মন্টু ডাক্তার)

 

১৯৩৬-২০১১ খ্রি.

ভূমিকাঃ সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা দেশ ও জাতির কল্যাণে আজীবন কাজ করে গেছেন কাজ করে গেছেন নিজের সর্বস্ব উজাড় করে। এমনই একজন মানুষ ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ (মন্টু ডাক্তার)। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই কৃতিসন্তান একাধারে একজন সফল চিকিৎসক,রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী, নাট্যকর্মী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও কমান্ডার ছিলেন। তিনি বলতেন, “যুদ্ধ করেছি দেশ স্বাধীন করার জন্য, স্বীকৃতি নেয়ার জন্য নয়। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের গুণিজনদের মধ্যে তিনি অন্যতম ব্যক্তিত্ব।

 

ন্মপরিচয়ঃ  ডা. মঈন উদ্দীন আহমেদ মন্টু ডাক্তার ১৯৩৬ সালের ১নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার অন্তর্গত মনাকষা ইউনিয়নের পিয়ালীমারী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ডা. কলিম উদ্দীন আহমেদ। তিনিও একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন। মাতার নাম বেগম দেল আফরোজ।

 

শিক্ষাজীবনঃ ডা. মঈন উদ্দীন আহমেদ এর শিক্ষায় হাতেখড়ি মনাকষা এম. ই. স্কুলে যার বর্তমান নাম মনাকষা প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে মনাকষা হুমায়ন রেজা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে IAC পাশ করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

 

সংসারজীবনঃ ডা. মঈন উদ্দীন আহমেদ মন্টু ডাক্তার ১৯৬১ সালে রোকেয়া আহমেদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়েসহ সাত সন্তানের জনক। তার মেজো ছেলে ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ উপজেলা) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

 

চিকিৎসেবা/কর্মজীবনঃ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এলএমএফ ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। পরে তিনি ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ' এমবিবিএস ডিগ্রী লাভ করেন। চিকিৎসক হিসেবে ডা. মঈনউদ্দীন আহমেদ মন্টু ডাক্তার শিবগঞ্জ উপজেলায় স্বনামধন্য ও জনপ্রিয় হয়ে বিশাল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে জটিল ডেলিভারির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আন্তরিক এবং অত্যন্ত পারদর্শী। তাঁকে সবাই জীনের ডাক্তার বলতো, কারণ রাত-দিন যখনই প্রয়োজন পড়তো, মটরসাইকেলে ছুটে যেতেন রোগীর সেবায়। চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করাই ছিল তার মূল ব্রত। কখনো কখনো গরীব রোগী দেখার পর নিজের ব্যাগে রাখা ওষুধ ও স্যালাইন বিনামূল্যে দিয়ে দিতেন। চেম্বারে এসেও গরীব রোগীরা অনেক সময় ভিজিট দিতোনা কিন্তু ভিজিট না পেলেও তিনি রোগীর সেবায় কখনও কোনো ত্রুটি রাখতেন না। রাজনীতিবিদ হওয়ায় তাঁকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হতো। কিন্ত তবুও কোথাও রোগীর অবস্থা খারাপ শুনলে তিনি গভীর রাতের তোয়াক্কা না করে ঔষধপত্র নিয়ে সেখানে ছুটে যেতেন। কেননা, তখন গ্রামাঞ্চলে এখনকার মতো ঔষধপত্র পাওয়া যেতোনা।

 

রাজনৈতিকজীবনঃ ডা. মঈন উদ্দীন আহমেদ মন্টু ডাক্তার ছিলেন সফল রাজনীতিবিদ। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ এর অসহযোগ আন্দোলন, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ, সংগঠক ও সাব-সেক্টরকমান্ডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তাঁকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সফলতা এনে দিয়েছে। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ১৯৫৬-১৯৬০ পর্যন্ত তিনি শিবগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন এবং রাজশাহী কলেজ ও রাজশাহী মেডিকেলে পড়ার সময় সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছেন। ১৯৬২ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি প্রথম মনাকষা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। ডা, মঈন উদ্দীন আহমেদ গণপরিষদের সদস্য হন। এরপর ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পূর্ব পর্যন্ত জাতির জনকের আস্থাভাজন  রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন তিনি। ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালে ডা. মঈন উদ্দীন আহমেদ দুইবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

 

মুক্তিযুদ্ধে অবদানঃ ২৫ মার্চ কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনী আকস্মাৎ দেশবাসীর উপর হামলা করলে ডাক্তার মন্টু শিবগঞ্জের মানুষকে সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ২১ এপ্রিল পাক বাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করে নিলে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মতো ডাক্তার মন্টুও ভারতের মালদহে চলে যান। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আসার পূর্বে তিনি মোহদীপুর সাব সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ধোবড়া, খাসেরহাট, আদমপুর, দুর্লভপুর, কলাবাড়ীসহ শিবগঞ্জ থানার বিভিন্ন স্থানে শত্রু সৈন্যদের উপর হামলা চালিয়ে তাদের ব্যাপক ক্ষতি করে তাদের ফেলে রাখা অস্ত্র হস্তগত করেন। যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তিনি আড়গাড়া ও খাসেরহাট অঞ্চলে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরী করে বহুলোকের চিকিৎসা সেবা করেন। যুদ্ধকালীন সময় তিনি বিভিন্ন অপারেশন প্লান করতেন এবং সহযোদ্ধাদের ব্যাচ করে ট্রেনিং ক্যাম্পে  পাঠিয়ে ট্রেনিং শেষে তাদের দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাতেন। শুধু তাই নয় তিনি নিজেও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। ১৪ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর যে যুদ্ধে শহীদ হন তাতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েও তিনি ভারতে গিয়ে অবস্থান না করে অস্ত্রহাতে শত্রুর মোকাবেলা করতে যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তা সত্যি অনন্য।

 

সমাজসেবায় অবদানঃ ডা, মঈন উদ্দীন আহমেদ (মন্টু ডাক্তার) সমাজসেবায় ব্রতী ছিলেন। সকলের সমস্যা তিনি অত্যন্ত ধৈৰ্য্য সহকারে শুনতেন এবং সমাধান দিতেন। তিনি এলাকার স্কুল, কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সক্রীয় ছিলেন। তিনি মনাকষা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আলিয়া মাদ্রাসা, শিবগঞ্জ কলেজ ও শিবগঞ্জ মহিলা কলেজের  অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৬ সালে আদিনা ফজলুল হক কলেজ ও শিবগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের জাতীয়করণ তার উদ্যোগেই হয়েছিল। শিবগঞ্জের রাস্তাঘাট, ব্রিজ এবং শিবগঞ্জ সোনামসজিদের রাস্তার উন্নয়ন তারই উদ্যোগের ফসল। কর্মচঞ্চল, সদালাপী ও মিষ্টভাষী মানুষটি অসুস্থতার জন্য ২০০৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে রাজনীতি ও চিকিৎসা পেশা থেকে অবসরগ্রহণ করেন। এরপর তিনি মনাকষার বাড়িতে হুইল চেয়ার ও বিছানায় বসে দিন কাটাতে থাকেন। এক সময়ের মঞ্চ কাপানো বক্তা শেষকালে শুধুই দুই একটি শব্দ ছাড়া কিছুই বলতে পারতেন না। অবশেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এই কৃতিসন্তান গত ০২ সেপ্টেম্বর ২০১১ খ্রি. শুক্রবার সকালে মৃত্যুবরণ করেন।